সত্যজিৎ রায় এক এবং অদ্বিতীয়। বাংলা চলচ্চিত্রকে তিনি নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। মূলত, তাঁর সিনেমা দিয়েই বাংলা চলচ্চিত্র পৌঁছে গিয়েছিল আন্তর্জাতিক মহলে। আজ এই মহামানবের প্রয়াণ দিবস।
সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক বাড়ি ছিল কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসুয়া গ্রামে। তবে তিনি ১৯২১ সালের ২ মে উত্তর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায় ও মা সুপ্রভা দেবী। সত্যজিৎ রায়ের ডাকনাম ছিল মানিক।
পাঁচ বছর বয়সে সত্যজিৎ রায় গড়পার ছেড়ে চলে আসেন ভবানীপুরের বকুল বাগানে। ৯ বছর বয়সে ভর্তি হন বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে। পরবর্তীতে, ইকোনমিকস নিয়ে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯৪০ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর শান্তিনিকেতনের কলাভবনে পড়াশুনা করেন।
১৯৪৩ সালে তিনি কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ শুরু করেন। বিজ্ঞাপন ও প্রকাশনার জগতে গ্রাফিক শিল্পী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ অন্য এক মাত্রা যোগ করে। এই পেশায় থাকার সময় ‘পথের পাঁচালী’র ছোটদের সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেঁপু’র প্রচ্ছদ আঁকতে গিয়ে ‘পথের পাঁচালী’কে চিত্রায়িত করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণ করেন। ‘পথের পাঁচালী’ মোট ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট’ পুরস্কারটি।
সত্যজিৎ রায় চিত্রনাট্য রচনা, চরিত্রায়ণ, সংগীত স্বরলিপি রচনা, চিত্রগ্রহণ, শিল্পনির্দেশনা, সম্পাদনা, প্রচারপত্র নকশা করাসহ নানা কাজ করেছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের বাইরে তিনি ছিলেন একাধারে কল্পকাহিনি লেখক, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ ও চলচ্চিত্র সমালোচক।
সত্যজিৎ রায় হচ্ছেন দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, যাকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছিল। ফ্রান্সের সরকার সত্যজিৎ রায়কে ১৯৮৭ সালে সে দেশের বিশেষ সম্মানসূচক পুরস্কার লেজিওঁ দনরে ভূষিত করে। ১৯৮৫ সালে সত্যজিৎ রায় ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কারে ভূষিত হন।
১৯৯২ সালে সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর কিছুদিন আগে একাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস (অস্কার) তাঁকে বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করে। এছাড়াও, ভারত সরকার ‘ভারতরত্ন’ প্রদান করে তাঁকে।
সত্যজিৎ রায় একে একে আমাদের উপহার দিয়েছেন, ‘অপরাজিত’, ‘অপুর সংসার’, ‘পরশপাথর’, ‘জলসাঘর’, ‘তিন কন্যা’, ‘দেবী’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘ঘরে-বাইরে’, ‘চারুলতা’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘নায়ক’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘গণশত্রু’, ‘শাখা-প্রশাখা’, ‘আগন্তুক’ প্রভৃতি সিনেমা।
‘অপরাজিত’, ‘অপুর সংসার’ আর ‘পথের পাঁচালী’—এ তিনটি চলচ্চিত্র একত্রে ‘অপু ট্রিলজি’ হিসেবে পরিচিত। ‘অপরাজিত’ ছবির সাফল্য সত্যজিৎ রায়কে আন্তর্জাতিক মহলে আরও বেশি পরিচিতি দেয়।
বাংলা চলচ্চিত্র ছাড়াও সত্যজিৎ রায় ১৯৭৭ সালে ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ নামের একটি হিন্দি ও উর্দু সংলাপ নির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এটিই ছিল বাংলা ভাষার বাইরে অন্য ভাষায় নির্মিত সত্যজিৎ রায়ের প্রথম চলচ্চিত্র। শুধু তা-ই নয়, ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ হচ্ছে সত্যজিৎ রায় নির্মিত সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও তারকাসমৃদ্ধ ছবি। ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন সঞ্জীব কুমার, সাইদ জাফরি, আমজাদ খান, শাবানা আজমি, ভিক্টর ব্যানার্জি ও রিচার্ড অ্যাটেনবরোর মতো তারকা অভিনয়শিল্পীরা।
১৯৮৩ সালে সত্যজিৎ রায় হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন। ১৯৮৪ সালে সত্যজিৎ রায় ‘ঘরে বাইরে’ ছবিটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত করেন। এই ছবিতেই সত্যজিৎ প্রথমবারের মতো একটি চুম্বন-দৃশ্য যোগ করেন। ১৯৮৭ সালে সত্যজিৎ তাঁর বাবা সুকুমার রায়ের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন।
১৯৯২ সালে হৃদ্যন্ত্রের জটিলতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন সত্যজিৎ রায়। ঐ বছরই ২৩ এপ্রিল অনন্তলোকে পাড়ি জমান আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন, কিংবদন্তি এই চলচ্চিত্রকার।
তাঁর প্রয়াণ দিবসে গভীর শ্রদ্ধা।