সম্পদের প্রাচুর্যে পূর্ণ দেশের দ্বীপ রাজ্য ভোলা। এ অঞ্চলের শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের উত্তরে ভেদুরিয়া ইউনিয়নে প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ গ্যাসের সন্ধান পাওয়ার পর ভোলার গ্যাসের রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুটে। কিন্তু সমস্যা একটাই মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে এর সংযোগহীনতা। এবার তা ঘুঁচতে যাচ্ছে দেশের অনবদ্য এক সুবার্তা হয়ে।
জানা গেছে, দেশের দীর্ঘতম ভোলা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ব্যয় কম হলেও নতুন এ প্রকল্পটি পদ্মা সেতুর থেকে বড়। দ্বীপ জেলা ভোলাকে বরিশালের সঙ্গে যুক্ত করতে এই সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিতে তেঁতুলিয়া ও কালাবাদোর নদীর ওপর দিয়ে বরিশাল-ভোলা সড়কে দেশের দীর্ঘতম ‘ভোলা সেতু’ নির্মাণ করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের অক্টোবরে এই সেতু নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণে নীতিগত অনুমোদন দেয় সরকার। অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় অনুমোদন দেয়া হয়। এখন অর্থের উৎস খোঁজা হচ্ছে। দাতা সংস্থার সবুজ সংকেত মিললেই শুরু হবে নির্মাণ কর্মযজ্ঞ। তবে চীনের পক্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত এ প্রকল্পে অর্থায়ন নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নতুন এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়ে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবু সালেহ্ মোস্তফা কামাল এ প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিতে তেঁতুলিয়া ও কালাবাদোর নদীর ওপর দিয়ে বরিশাল-ভোলা সড়কে ভোলা সেতু নির্মাণে প্রকল্প গ্রহণের নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছে।’
সেতু বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতু নির্মাণে আনুমানিক ১২ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা ব্যয় হবে।প্রস্তাবিত ভোলা সেতুর প্রভাব পদ্মা সেতুর মাধ্যমে আরও জোরদার করার চিন্তা করা হচ্ছে। সেতু বাস্তবায়নের পরে ভোলা জেলা সরাসরি পদ্মা সেতুর মধ্য দিয়ে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হবে। প্রস্তাবিত ভোলা সেতুটি নির্মিত হলে পদ্মা সেতুর প্রভাব অর্থনীতে আরওদৃশ্যমান হবে বলে আশা করছে সেতু বিভাগ।
সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী মোঃ ফেরদৌস সংবাদমাধ্যমকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতু প্রকল্পের আওতায় দুটি নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করা হবে। মাঝে চরের ওপর চার কিলোমিটার ভায়াডাক্ট তৈরি করা হবে। সেতু নির্মাণে আনুমানিক ১২ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। সেতু নির্মাণে নকশা চুড়ান্ত হয়েছে ইতোমধ্যে। তবে নির্মাণ শুরুর পর খরচ আরও বেশি হতে পারে বলে জানান তিনি। সেতু নির্মিত হলে ভোলা থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আনার সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং এর মাধ্যমে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করার সুযোগ থাকবে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) জানিয়েছে, তারা সেতু নির্মাণের জন্য জরিপ করেছে এবং সেতুর সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণ করেছে। সেতুটি নির্মিত হলে দক্ষিণের এই দুটি জেলার মধ্যে যাতায়াতে সময় কম লাগবে এবং ভোলা থেকে গ্যাস সরবরাহ করা সহজ হবে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব বেলায়েত হোসেন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা এই সেতু নির্মাণে অর্থায়নকারী খুঁজছি। তিনি জানান, শীঘ্রই অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) চিঠি দিয়ে সেতুর তহবিল সংগ্রহের জন্য অনুরোধ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন প্রকাশ বিবিএর তিনটি প্রকল্পে অর্থায়নের আগ্রহ দেখিয়েছেন আর ভোলা সেতু তার মধ্যে একটি।
সেতু সংশ্লিষ্টরা জানান, জরিপ ও আলোচনার ভিত্তিতে ভোলার ভেদুরিয়া ফেরিঘাট এবং বরিশালের লাহারহাট ফেরিঘাট বরাবর সেতুটি বানানোর জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। ১০ কিলোমিটার সেতুর মধ্যে প্রায় তিন কিলোমিটার শ্রীপুর চরের ওপর দিয়ে যাবে।
এখন প্রায় ৩ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এবং প্রায় ২০ লাখ ৩৭ হাজার জনসংখ্যার জেলা ভোলার সঙ্গে বরিশালের সরাসরি স্থল যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। ভোলা যাওয়ার একমাত্র উপায় নদীপথ। যা উন্নয়নের গতিধারাকে অনেকভাবে ব্যাহত করে।
স্থানীয়রা মনে করেন, সেতু হলে অনেকেই প্রতিদিন বরিশাল থেকে যাতায়াত করে কাজ করতে পারবেন। গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগে আসবে বিরাট পরিবর্তন। যা অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
গত বছরের ৫ নভেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘খুব শীঘ্রই বরিশাল ভোলা সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হবে। তিনি রাজধানীর সেতু ভবনে সেতু বিভাগ এবং বিবিএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় বলেছিলেন, সেতুর ডিপিপির (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফর্মা) কাজ চলছে এবং অর্থায়নের বিষয়ে আলোচনা চলছে। চীন প্রকল্পটিতে অর্থায়নের আগ্রহ দেখিয়েছিল বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে শুরু করে সেতুর সম্ভাব্যতা জরিপ গত বছরের আগস্টে শেষ হয় বলে জানান বিবিএর এক কর্মকর্তা।
এই জরিপ সম্পন্ন করেছে ভারতের এসটিইউপি কনসালট্যান্ট প্রাইভেট লিমিটেড, যুক্তরাজ্যের সিওডব্লিউআই কনসাল্টিং এবং বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালট্যান্টস লিমিটেড ও ডেভ কনসালট্যান্টস লিমিটেড।
জরিপে ধারণা করা হয়, সেতুটি দিয়ে ২০২৪ সালে ৬ হাজার ৯৯০, ২০৩৪ সালে ১৫ হাজার ৬২০ এবং ২০৫৪ সালে ৫৬ হাজার ৭০১টি গাড়ি চলাচল করবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত ভোলা-বরিশাল সেতুতে রেললাইন না থাকায় এর ব্যয় পদ্মা সেতুর থেকে অনেক কম হবে। তাছাড়া জরিপ বলছে যে, নদী শাসনের জন্য তেঁতুলিয়া নদী পদ্মার মতো কঠিন হবে না।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৪ সালের আগেই তারা সেতুর কাজ শেষ করতে চান। তবে প্রকল্পের অর্থায়নের পর শুরু ও শেষ করার সময় নির্ধারণ করা হবে।
তাই বলা যায়, সম্ভবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে দেশের দক্ষিণে। প্রান্তের ভোলাকে ঘিরে নতুন উন্নয়ন প্রস্তাবনার প্রকৃত সময় এখনই।