১৯৭২ সাল, ১০ জানুয়ারি। ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিক বেলা ১ টা বেজে ৪১ মিনিট। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নেওয়া সদ্যপ্রসূত দেশটি অপেক্ষা করছে তার রাষ্ট্রনেতার জন্য। যিনি না থাকলে হয়তো স্বাধীন বাংলাদেশের এ স্বপ্নই পূরণ হতো না। অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখাতে ঠিক তখন বিমানবন্দর থেকে দেশের মাটিতে পা রাখেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এদিন দুপুরে এই মহানায়ককে বহনকারী বিমানটি যখন তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করে, তখন গোটা জাতি হর্ষধ্বনি ও গগনবিদারী ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে স্বাগত জানান প্রিয় নেতাকে। বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে সরাসরি চলে যান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেখানে লাখো মানুষের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের জন্য দেশবাসীকে অভিনন্দন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার কাজে সবাইকে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানান।
বিকেল পাঁচটায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, “সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙ্গাল আমি। আমি সব হারাতে পারি কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারবো না।”
এসময় স্বদেশের মাটি ছুঁয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্মাতা শিশুর মতো আবেগে আপ্লুত হয়ে কেঁদে ওঠেন। তাঁর দু’চোখ বেয়ে আনন্দ-বেদনার অশ্রুধারা নামে। আর প্রিয় নেতাকে ফিরে পেয়ে বাঙালি আনন্দে অশ্রুসিক্ত হয়ে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে তোলে বাংলার আকাশ বাতাস।
শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে তার ঐতিহাসিক ধ্রুপদী বক্তৃতায় বলেন, ‘যে মাটিকে আমি এত ভালবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারবো কি-না। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ধানমন্ডির নিজ বাসা থেকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী গ্রেপ্তার করে বঙ্গবন্ধুকে। বাঙালি যখন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে, বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে প্রহসনের বিচারে ফাঁসির আসামি হিসেবে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। বাঙালিদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার পর বিশ্বনেতারা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। পরাজিত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আন্তর্জাতিক চাপে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি ভোররাতে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে ছাড়া পান। এদিন বঙ্গবন্ধুকে বিমানে তুলে দেওয়া হয়। সকাল সাড়ে ছয়টায় তিনি লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে একটি বিশেষ ফ্লাইট ৬৩৫ এ করে অবতরণ করেন। লন্ডনে পৌঁছানোর পর সকাল ১০টার পর থেকে তিনি ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও টেলিফোনে কথা বলেন। পরে ব্রিটেনের বিমানবাহিনীর একটি বিমানে করে ৯ জানুয়ারি দেশের উদ্দেশে রওনা দেন।
১০ জানুয়ারি সকালে বিশেষ বিমানে চড়ে তিনি দিল্লিতে নামেন। সেখানে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সমগ্র মন্ত্রিসভা, তিনবাহিনীর প্রধান এবং অন্যান্য অতিথি ও সে দেশের জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা লাভ করেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিবুর রহমান।
দীর্ঘ ১০ মাসের বেশি প্রতীক্ষার পর ১০ জানুয়ারি দুপুরে বিজয়ের দেশে, বিজয়ীর বেশে, স্বপ্নের সোনার বাংলার মাটিতে পা রাখেন জাতির জনক। এর মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
বঙ্গবন্ধুর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করা হয়েছিল ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা। সেই থেকে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি নানা আয়োজনে পালন করে আসছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। আজ তার দেশে ফেরার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হলো।