fbpx

‘লাল মোরগের ঝুঁটি হচ্ছে সাহসের প্রতীক, লড়াইয়ের প্রতীক’

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

কানাডার টরন্টোতে মাল্টিকালচারাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হয় নূরুল আলম আতিক পরিচালিত ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ চলচ্চিত্রটি। উৎসবে সিনেমাটি দেখে নিজের প্রতিক্রিয়া লিখেছেন কানাডা প্রবাসী লেখক ফরিদ আহমেদ। বিবিএসবাংলার পাঠকের জন্য লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো। 

টরন্টো মাল্টিকালচারাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধন হয়েছে গতকাল বিকেলে। এই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করেছে টরন্টো ফিল্ম ফোরাম, যা সংক্ষেপে টিএফএফ নামে পরিচিত। উদ্বোধনী দিনে শেষ প্রদর্শন হিসেবে দেখানো হয়েছে নূরুল আলম আতিক পরিচালিত ছবি ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’।

নূরুল আলম আতিক আমার একজন অত্যন্ত পছন্দের পরিচালক। বাংলাদেশে যাঁরা এখনো শিল্প সাহিত্য নিয়ে নিবেদিতপ্রাণ, ভালো কিছু করার জন্য নিরন্তর তাড়া অনুভব করেন নিজেদের মধ্যে, আতিক তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
আতিককে আমি প্রথম দেখেছিলাম প্রথম আলোর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে। না, সামনাসামনি সেই অনুষ্ঠান দেখি নাই আমি। সেটার রেকর্ডেড ভিডিও দেখেছিলাম। তাঁর প্রথম নাটকের জন্য ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন তিনি। নাটকের নাম মনে নেই আমার। সেই নাটকটা প্রখ্যাত কোনো একজন সাহিত্যিকের গল্প থেকে নেওয়া হয়েছিলো। পুরস্কার নিতে গিয়ে আতিক বলেছিলেন মূল গল্পটা অনেক ভালো। তিনি সেটাকে ঠিকভাবে তুলতে পারেন নাই পর্দায়। উপস্থাপক এর উত্তরে বলেছিলেন, ঠিকভাবে না তুলতে পেরেই এই অবস্থা, তুলতে পারলে না জানি কী হতো। আতিক লাজুক হাসি দিয়েছিলেন উপস্থাপকের কথা শুনে।

যে ঘটনার কথা বললাম, সেটা অনেক বছর আগের ঘটনা। স্মৃতি থেকে লিখেছি। কাজেই কোনো তথ্য ভুল থাকলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। যাইহোক, আতিকের পরিচালনার চলচ্চিত্র এখানে দেখানো হবে, আর আমি দেখবো না, সেটা হয় না। বসবাস একা একা করতে ভালো লাগলেও, মুভি দেখতে হয় দলবেঁধে। দল ভারি করার জন্য উইলিয়াম আর অ্যাডেলকে বললাম, সমরেশ দা, দেবী বৌদিকে বললাম। সবাই এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলো। টিএফএফের সাথে যোগাযোগ করে টিকেটের ব্যবস্থাও করে ফেললাম আমি।

মুভি দেখানোর জন্য সিনেপ্লেক্সের একটা হল ভাড়া নিয়েছিলো টিএফএফ। প্রায় তিনশো ক্যাপাসিটির হলের পুরোটাই দর্শকে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো এই ছবি দেখার জন্য।

‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ক্যানভাস বিশাল। বিশাল বলেই অনেক সময় সেটাকে চলচ্চিত্রে তুলে আনা দুঃসাধ্য একটা ব্যাপার। কিন্তু, বিশাল ক্যানভাসের আবার সুবিধাও আছে। এই ক্যানভাসের আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে অনেক তারকাখচিত আকাশ। আমাদের চলচ্চিত্রকারদের অনেকেই সেই ক্যানভাসের অংশ বিশেষের দিকে নজর দিতে চান না। তাঁরা সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে আনতে যান। আর সেটা করতে গিয়ে অবধারিতভাবেই ব্যর্থ হন। আতিক তাঁর এই চলচ্চিত্রে মুক্তি সংগ্রামের একটা অংশকে বেছে নিয়েছিলেন। আর সেই অংশটাকেই তিনি উপস্থাপন করেছেন দক্ষতার সাথে। শুধু দক্ষতার সাথে বললে ভুল হবে, সেই পরিবেশনা ছিলো দারুণভাবে শিল্পসম্মত। চলচ্চিত্রের আসল আবেদন হচ্ছে তার নান্দনিকতায়। সেই আবেদন এই চলচ্চিত্রে উপস্থিত ছিলো শতভাগ।

চলচ্চিত্রের পটভূমি হিসেবে আতিক বেছে নিয়েছিলেন সৈয়দপুরকে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সৈয়দপুর একটা আলাদা বিশেষত্ব নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলো। এই শহরের বিহারিদের উপস্থিতি ছিলো প্রচণ্ড শক্তিশালীভাবে। বাঙালি মুসলমান, বাঙালি হিন্দু, পাকিস্তানি বাহিনী এবং বিহারি, এই চারটে পক্ষের একত্র অবস্থান সৈয়দপুরকে আলাদা এক মাত্রা দিয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। একজন চলচ্চিত্র পরিচালকের কাছে এই সব উপাদান দারুণভাবে কাম্য তার চলচ্চিত্রের জন্য। এই নানাবিধ পক্ষগুলো পারস্পরিক সম্পর্ক, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, শত্রুতা, চলচ্চিত্র প্রাণ প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করে। আতিক সেগুলোকে কাজে লাগিয়েছেন সুচারুভাবে।

‘লাল মোরগের ঝুঁটি হচ্ছে সাহসের প্রতীক, লড়াইয়ের প্রতীক’চলচ্চিত্রের কাহিনিকাল চার মাসব্যাপী। অগাস্ট থেকে শুরু করে নভেম্বরে গিয়ে শেষ হয়েছে চলচ্চিত্রের কাল। সৈয়দপুর বিমানবন্দরের রানওয়েকে মেরামত করার জন্য পাকিস্তান আর্মির প্রয়োজন ছিলো মজুরের। সেই মজুর তারা স্থানীয় বিহারি এবং বাঙালি দালালদের মাধ্যমে সংগ্রহ করা শুরু করে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে দাস হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে তারা। শুধু শ্রম দিতেই বাধ্য করা হয় না, এদের উপরে জাতিগত ঘৃণার উপজাত হিসেবে অকথ্য নির্যাতনও চালানো হয়। এর সাথে সাথে নারী নির্যাতন, হিন্দু নিধন সবই চলতে থাকে।

আমার চলচ্চিত্র বিষয়ে টেকনিক্যাল কোনো জ্ঞান নেই। কাজেই, কোনো টেকনিক্যাল আলোচনাতে আমি যাচ্ছি না। একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে এই ছবির ভালো লাগা এবং মন্দ লাগার কিছু জায়গা নিয়ে আমি সংক্ষেপে কিছুটা কথা বলে যাচ্ছি। সেই আলোচনা হয়তো বোদ্ধা দর্শকদের কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে। হলেও, আমি তাতে কিছু মনে করবো না। কারণ, আগেই বলেছি চলচ্চিত্র সম্পর্কে আমার কোনো জ্ঞান নেই। এটা কথার কথা নয়, বাস্তব সত্যি কথা।
‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ সিনেমার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে ক্যামেরার কাজ। ছবিটার ক্যামেরাম্যান কীভাবে ক্যামেরা চালিয়েছেন, আমি জানি না। কিন্তু, পর্দায় সেই ছবি দেখলে কবিতার পঙক্তিমালা বলে মনে হয়। ক্যামেরা দিয়ে রাতের দৃশ্যায়ন করা মনে হয় সবচেয়ে কঠিন কাজ। অথচ এখানে রাত কিংবা সন্ধ্যার দৃশ্যগুলো এসেছে নান্দনিক রূপের পসরা সাজিয়ে। চাঁদ, চাঁদের আলো, গাছপালা, ঘরবাড়ি, সবকিছু শিল্পীর হাতের তুলি দিয়ে আঁকা মনে হয়েছে। কখনো কখনো ক্যামেরাকে ধরা হয়েছে উঁচু থেকে। ফলে, পাত্রপাত্রীদের ত্রিমাত্রিক মুভমেন্ট ভেসে উঠেছে দর্শকের চোখে। একটা দৃশ্যে দীঘির অন্য প্রান্ত থেকে ক্যামেরা ধরা হয়েছিলো। এটা একটা লং শট। কিন্তু, ফ্রেমে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এমনভাবে কথা বলতে বলতে গেছেন যে মনে হয়েছে ক্লোজ শট নেওয়া হচ্ছে। লং শট এবং ক্লোজ শটের এমন ধ্রুপদী সংমিশ্রণ দারুণ লেগেছে।

‘লাল মোরগের ঝুঁটি হচ্ছে সাহসের প্রতীক, লড়াইয়ের প্রতীক’

মুক্তিযুদ্ধের ছবির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সময়কালটা। যুদ্ধটা হয়েছে এখন থেকে একান্ন বছর আগে। স্বাভাবিকভাবেই সেই সময়টা আর আজকের সময়টা এক না। পোশাক, আশাক থেকে শুরু করে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, মানুষের কথা বলার স্টাইল, আচার-আচরণ, সবকিছুই এই অর্ধ শতাব্দীতে পরিবর্তিত হয়েছে। ফলে, সেই সময়টাকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে আনাটা আমাদের মতো দেশের পরিচালকদের পক্ষে কিছুটা অসম্ভবই। কারণ, আমাদের পরিচালকরা যে পরিমাণ অর্থ নিয়ে চলচ্চিত্র করতে নামেন, সেটা দিয়ে বিশ্বাসযোগ্য সেট তৈরি করা সম্ভব হয় না। আতিক এই জায়গাতে সফল। তাঁর ছবিতে একাত্তর এবং একাত্তরের সময়কাল উঠে এসেছে দারুণ বিশ্বাসযোগ্যভাবে। ছবিটা দেখে একবারও মনে হয়নি যে একটা নকল বা সাজানো সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। চোখের সামনে একাত্তরের সৈয়দপুরকেই দর্শক দেখেছে। একজন বাঙালি মুসলমান যেমন হয়, হিন্দু মুসলমান যেমন হয় বা বিহারি যেমন হয়, ঠিক সেই রকমভাবেই পর্দায় এসেছে তারা। বিশ্বাসযোগ্য পটভূমি হবার পাকিস্তান বাহিনী এবং তাদের দোসর বিহারি ও বাঙালি দালালদের নির্মমতা দর্শকের গায়ে কাঁটা দিয়েছে। মনে হয়েছে সত্যি সত্যিই ওগুলো ঘটছে আমাদের চোখের সামনে।

‘লাল মোরগের ঝুঁটি হচ্ছে সাহসের প্রতীক, লড়াইয়ের প্রতীক’এর জন্য অবশ্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বাস্তব অভিনয়ও খানিকটা দায়ী। এদের কাছ থেকে সেরাটা নিংড়ে নিয়েছেন পরিচালক আতিক। তাদের গেট আপ যেমন যথোপযুক্ত ছিলো পাকিস্তান আর্মির ক্যাপ্টেন চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন, তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের বহু ছবি দেখেছি আমি, কিন্তু পাকিস্তান আর্মি অফিসারের চরিত্রে এই ভদ্রলোকের মতো দুর্দান্ত অভিনয় আর কেউ করেছে বলে দেখি নাই আমি।

এই ছবির যে বিষয়গুলো আমার ভালো লাগেনি, সেগুলো বলি। প্রথমে আমার কাছে মনে হয়েছে এটাকে অহেতুক লম্বা করা হয়েছে। বাংলাদেশে ফিচার ফিল্ম মানেই দুই বা আড়াই ঘণ্টার মুভি করতে হবে, এ রকম একটা বদ্ধমূল ধারণা মনে হয় পরিচালকদের মাথার মধ্যে আছে। যে কারণে অনেক সময় বাহুল্য বিষয় চিত্রনাট্যের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে একে মেদ সর্বস্ব করে ফেলেন। একজন ভালো পরিচালকের এই অনাকাঙ্ক্ষিত মেদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয়। আতিক যদি এটাকে এক ঘণ্টা পনেরো বা বিশ মিনিটের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতেন, সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় একটা নির্মেদ চলচ্চিত্র পেতাম আমরা।
ছবির মূল চরিত্র পদ্ম-র ভূমিকায় যিনি অভিনয় করেছেন, তিনি অভিনয় খারাপ করেন নাই। কিন্তু, অত্যন্ত স্বাস্থ্যবতী এক নারী তিনি। একাত্তরের সময়কালটা আমি গ্রামে কাটিয়েছি। ওই সময় আমি গ্রাম্য নারীদের যে অবস্থায় দেখেছি, তার সাথে এই নারী মেলেনি। সেই সময়ে গ্রামের দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের মধ্যে এমন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী লাবণ্যময় নারী খুঁজে পাওয়া দুরূহ ছিলো। সুষম খাদ্যের অভাব এবং প্রচণ্ড পরিশ্রমের কারণে তাদের গায়ে মেদ থাকাতো অনেক দূরের কথা, এদের বেশিরভাগই ভয়াবহভাবে রুগ্ন স্বাস্থ্যের ছিলো। স্বাভাবিকভাবেই লাবণ্য বলতে তেমন কিছু ছিলো না তাদের চেহারা এবং শরীরে। শুধু পদ্ম না, আরেকজন যিনি হিন্দু গর্ভবতী নারী চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনিও কিঞ্চিৎ পৃথুলা। ওটাকে অবশ্য এড়িয়ে যাওয়া যায় তিনি গর্ভবতী ছিলেন বলে।

আগেই বলেছি, একাত্তরের অগাস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়কালকে চলচ্চিত্রে তুলে এনেছেন পরিচালক। এই সময়কালের এই ছবিতে প্রকটভাবে যেটা অনুপস্থিত সেটা হচ্ছে বাঙালিদের প্রতিরোধ। একটা চরিত্রের মাধ্যমে যদিও বা অপারেশন জ্যাকপটের কথা বলা হয়েছে, রেডিওতে মাঝেমধ্যে যুদ্ধের খবর এসেছে। কিন্তু, ওগুলোকে বাদ দিলে আর কোথাও বাঙালিদের প্রতিরোধের কোনো অস্তিত্ব পরিচালক রাখেননি। পাকিস্তান আর্মি বিনা বাধায় চলাফেরা করছে, নির্মমভাবে মানুষের উপর অত্যাচার করছে, তাদের ধরে এনে শিকল বেঁধে নাচাচ্ছে, মেয়েদের ধর্ষণ করছে, আস্ত মুরগি খাচ্ছে, লড়াই করা মোরগ ধরে এনে মোরগ যুদ্ধ বাধিয়ে তামাশা দেখছে, তাদের সহযোগী দালালরা বিনা বাধায় যা খুশি তাই করে চলেছে। সামান্যতম দুশ্চিন্তাও তাদের করতে দেখা যায় নি বাঙালিদের প্রতিরোধ নিয়ে। যেনো ওইরকম কিছু ছিলোই না সেই সময়ে। অথচ, নভেম্বরে মুক্তিযোদ্ধারা সাঁড়াশি আক্রমণ শানাচ্ছে সারা দেশজুড়ে। সৈয়দপুরে মুক্তিযোদ্ধারা যদি নাও ঢুকে থাকে তখন, তারপরেও পাকিস্তান আর্মিদের দেশের বাকি অংশের কথা ভেবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকার কথা ছিলো। সে রকম কিছু তাদের দেখে মনে হয় নাই। হাসিমুখে তারা ওখানে অত্যাচারের পর অত্যাচার করে গিয়েছে। এই ক্রমাগত অত্যাচার দেখাটা দর্শক হিসাবে খুব ডিপ্রেসিং। মনে হয়েছে ধরে বেঁধে আমাদের মারা হচ্ছে শুধু। আমরা সেই মার খাচ্ছি পড়ে পড়ে, বিনা প্রতিরোধে। একাত্তরে এমন ছিলো না। আমরা যেমন মার খেয়েছি সত্যি, একইভাবে পাকিস্তানিদের কঠিন মারও দিয়েছি। শেষ দৃশ্যে গিয়ে যদিও পদ্ম পাকিস্তান আর্মি অফিসারকে দা দিয়ে কুপিয়েছে, কিন্তু সেটা খানিকটা অবান্তর এবং অতি নাটকীয় মনে হয়েছে। পুরো ছবির সাথে খাপ খায়নি এই দৃশ্য। সম্পূর্ণ ছবি জুড়ে পরিচালক দর্শককে যে ডিপ্রেশনের মধ্যে রেখেছিলেন, সেটার ক্ষতিপূরণ তিনি দিতে চেয়েছেন ওই এক দৃশ্যের মাধ্যমে খুব সম্ভবত।

ছবিটার নাম অসাধারণ। একাধারে এটা যেমন কাব্যিক, একই ভাবে রূপকও। লাল মোরগের ঝুঁটি হচ্ছে সাহসের প্রতীক, লড়াইয়ের প্রতীক। ছবিতে একটা লড়াই করা মোরগও আছে, যেটাকে পদ্ম বাঘা নামে সম্বোধন করে। এই মোরগটা ছবির মূল চরিত্র হতে পারতো, হতে পারতো বাঙালিদের প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রতীক। হয়তো সে কারণে ছবির নামকরণ করা হয়েছে এভাবে। চলচ্চিত্রের শুরুতেই মোরগ লড়াইয়ের এনিমেশন দেখানো হয়েছে। কিন্তু, মূল ছবিতে এর কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। ছবিতে মোরগটা আলাদা কোনো বিশেষত্ব নিয়ে আসেনি। সেটাকে এক পর্যায়ে গিয়ে চুরি করে নিয়ে যায় বিহারি দালাল। পাকিস্তান আর্মির মনোরঞ্জনের জন্য মোরগ লড়াইয়েরও আয়োজন করা হয়। কিন্তু, সেটা শুধু খেলা হিসাবেই থেকে যায়। ওটাকে প্রতীকী চরিত্র বানাতে গেলে মুখেই শুধু বানাতে হবে, চলচ্চিত্র দেখার সময় দর্শক সেই লড়াইকে প্রতীকী লড়াই হিসাবে দেখবে না। দেখার কোনো কারণও নেই। ছবিটার সবচেয়ে সম্ভাবনার জায়গা ছিলো এখানে, সেই সম্ভাবনার জায়গাটাতেই নিবিড় ব্যর্থতা চোখে পড়েছে আমার।

এতো সব সমালোচনা করছি বলে ভেবে নিয়েন না যে এটা একটা খারাপ চলচ্চিত্র। ছবিটা মোটেও খারাপ নয়, বরং বলবো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করা অন্যতম একটা শিল্পসম্মত ছবি এটা। আমি সমালোচনা করছি এ কারণে যে এই ছবিটার অসাধারণ এক ছবি হয়ে ওঠার অনন্ত সম্ভাবনা ছিলো। এই ছবির থিমের সাথে হলিউডের বিখ্যাত ছবি ‘ব্রিজ অন দ্য রিভার কোয়াই’ এর মিল রয়েছে। ওই ছবির কাছাকাছি মানের একটা ছবি আমরা পেতে পারতাম যদি এর চিত্রনাট্যকে সফলভাবে চিত্রায়ন করা যেতো। সেটা হয়নি। এর জন্য যে পরিচালক দায়ী, তা আমি বলছি না। আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। যে ধরনের স্বল্প বাজেট নিয়ে পরিচালকরা কাজ করেন, সেটা দিয়ে খুব ভালো কিছু করা সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে। এই সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েও যে এমন একটা ছবি করেছেন আতিক, সে জন্যই শতকোটি ধন্যবাদ প্রাপ্য তাঁর। শিল্পের সাথে সততার সম্পর্ক সবার থাকে না। আতিকের সেটা আছে শতভাগ।

আমার সাথে ছবি দেখেতে যাঁরা গিয়েছিলেন, তাঁদের কথা দিয়ে শেষ করি। অ্যাডেল এবং আমার স্ত্রী আন্নার কাছে ছবিটা অসম্ভব ভালো লেগেছে। তদের চোখে ছবির কোনো খুঁত নেই। উইলিয়ামের কাছেও ভালো লেগেছে। তার কাছে অবশ্য ভাল লাগারই কথা। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়েছে, তখন সে টগবগে এক তরুণ, কোলকাতায় গান-বাজনার সাথে জড়িত ছিলো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাকে ছুঁয়ে গিয়েছিলো সেই সময়। যে কারণে ওই একুশ-বাইশ বছর বয়সেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গান লিখেছিলো সে, সেই গানে সুর দিয়েছিলো এবং গেয়েও বেড়াতো। ছবিটা চলার সময়েই গলা নিচু করে অসংখ্য প্রশ্ন করে গিয়েছে সে আমাকে। সৈয়দপুরের সামাজিক কাঠামোটা বোঝার চেষ্টা করেছে নানা প্রশ্নের মাধ্যমে। বিশেষ করে যুদ্ধে বিহারিদের ভূমিকাটা তার কাছে নতুন ছিলো। বেশির ভাগ প্রশ্ন ওই সংক্রান্তই ছিলো।
সবশেষে বলবো, ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’-র মতো আরো অনেক অনেক চলচ্চিত্র হোক বাংলাদেশে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এক বিশাল ক্যানভাস। বিস্তীর্ণ এই প্রান্তরে পড়ে রয়েছে অসংখ্য মণি-মুক্তো-মাণিক্য। এইসব রত্নের সন্ধানে সেই ক্যানভাসের নানা অংশে চলচ্চিত্র পরিচালকরা অনুসন্ধান চালাক। আর সেই অনুসন্ধানের ফল হিসেবে আমাদের মহত্তম সব চলচ্চিত্র উপহার দিক। ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’-র উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।

ফরিদ আহমেদ, কানাডা প্রবাসী লেখক

Advertisement
Share.

Leave A Reply