আচ্ছা, আপনি কি কখনো দেখেছেন আপনার মা একা একা নিজের মত করে খানিকটা সময় কাটাচ্ছেন? অথবা তিনি টুকটাক শরীর খারাপে পরিবারের জন্য খাবার তৈরি না করে আরাম করছেন? এমন দৃশ্য আমাদের দেশের মায়েদের ক্ষেত্রে বিরল।
শুধু মা কেন, যেসব মেয়েরা মা হননি এখনও, তারাও সংসারে ঢুকে গেলে একটা সময় নিজের কথা ভাবতেই ভুলে যান। পরিবারের অন্যদের কথা ভাবতে ভাবতে নিজের জন্যও যে একটু সময় দরকার সেটা বুঝতেই পারেন না মেয়েরা। আপনি অনেক সময় খেয়াল করবেন, পরিবারের পুরুষ মানুষটি কিন্তু কাজের ফাঁকেও বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে, কিছুটা সময় বই পড়ছে, সিনেমা দেখছে।
কিন্তু বাড়ির বৌ এর যেন একটুও ফুসরত নেই। কার কী খাবার দিতে হবে, সংসারে কার শরীর খারাপ, কী বাজার করতে হবেসহ আরও কত দিকে যে নজর দিতে হয় সংসারে একজন নারীর তা বলাই বাহুল্য। তবে দিনশেষে প্রতিটি নারীর মনে রাখা উচিত, তিনি মানুষ, যন্ত্র নন।
আপনি আপনার পরিবারের কথা অবশ্যই ভাববেন, তাই বলে নিজেকে বাদ দিয়ে নয়। মনে রাখবেন, আপনি মনে এবং শরীরে সুস্থ এবং আনন্দময় থাকলেই কেবল পরিবারের সবার দিকে সুন্দর ভাবে নজর দিতে পারবেন। নিজে যদি সুস্থ, সুখী না অনুভব করেন, আরেকজনকে ভালো রাখা সম্বব? আর সবকিছুর আগে মনে রাখা দরকার সংসারের সবার ভালো রাখার দায়িত্ব আপনার একার না। প্রত্যেকের দায়িত্ব নিজের ভালো রাখা। আপনি একা কেন সবার দায়িত্ব নেবেন? বিশেষ করে নিজের কথা একদম না ভেবে! নিজের কথা ভাবার পাশাপাশি অন্যের কথা ভাবুন। এতে করে শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্লান্ত কম হবেন। নয়তো দেখবেন একটা সময় গিয়ে, আপনি ক্লান্ত হয়ে যাবেন এতো এতো দায়িত্ব পালন করতে করতে।
আর এক্ষেত্রে আপনাকে আগে নিজের অভ্যাসে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। বদল আনতে হবে প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রে- প্রতিদিনের রুটিন, নিজের সম্পর্কে ধারণা এবং কর্তব্য-দায়িত্বের বোঝা নিয়ে।
যতক্ষণ না কেউ সাহায্য চাইছেন, ততক্ষণ অপেক্ষা করুন। আগবাড়িয়ে কাজ করা বা সাহায্যের অভ্যাসটা ধীরে ধীরে ছেড়ে দিন। এতে স্ট্রেস এবং শারীরিক খাটনি কমবে কিছুটা হলেও। ‘না’ বলতে শিখুন। সবার সব নির্দেশ বা চাহিদা মাথা পেতে না মেনে নিতে সাধ্য মতো চেষ্টা করুন। যেটা পারবেন না সেটা কথার কায়দায় জানিয়ে দিন। প্রয়োজনে সরাসরি ‘না’ বলুন। প্রথম প্রথম এই নিয়ে বাড়িতে অশান্তি হতে পারে। কিন্তু দেখবেন ধীরে ধীরে পরিবারের সদস্যরা তাতেও অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন। তবে আপনাকেও আবেগপ্রবণতা কমাতে হবে।
শুরু হোক আজ থেকেই
নারীদের সকাল শুরু হয় বেশিরভাগ সময় রান্নাঘর দিয়ে। তাই পরিবর্তনের শুরুটা হোক রান্নাঘরেই। হিসেব করে দেখুন, রান্না ঘরের কোন কোন জিনিসপত্র অকারণে কেনাকাটা হয়। সেগুলোর একটা লিস্ট করুন। প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা বাজার না করে বাড়ির সকলকে একই জিনিস বা খাবারে অভ্যস্ত করার চেষ্টা শুরু করুন। মাসের প্রথমেই বাজার সেরে ফেলুন। এতে খরচ যেমন বাঁচবে, সময়ও বাঁচবে।
অনেকেই বিয়ে করলে আর আগের বন্ধুদের সাথে নিয়মিত যোগারোখ রাখেন না। মোটকথা অনেকেই সময় পান না। বিশেষ করে মেয়েরা একটা সময় পরে বন্ধুদের থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। এমনটি ভুলেও করবেন না। ভালো বন্ধু আপনাকে অক্সিজেন দেবে। তাই মন ভালো রাখতে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করুন। আর, প্রতিবেশীদের নিজের পরিবারের ব্যাপারে কথা বলতে দেবেন না একদমই।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে অন্তত আধঘণ্টা নিজের সঙ্গে কাটান। যোগব্যায়াম করুন। গান শুনুন। কিংবা নিরিবিলিতে একা বসে থাকুন। একদিন দু’দিন নয়, নিজেকে ভালো রাখতে চাইলে এই অভ্যাসটিকে সারাজীবনের জন্য সঙ্গী করে নিন। আর প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে অবশ্যই এক গ্লাস পানি পান করুন।
পরিবর্তন আনুন রাতের রুটিনেও। রাতে এগারটার মধ্যে ঘুমিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন। পরিবারের অন্যদেরও এই নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা করুন। পরের দিনের দুপুরের খাবারের একটা বড় অংশ রাতেই তৈরি করে ফ্রিজে রেখে দিন। এতে অফিস যাওয়ার সময় তাড়াহুড়ো হবে না। মোটের উপর ঘুমের সময় বাড়ান। দিনে আট থেকে নয় ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। ঘুম ঠিকমতো হয় না বলেই শরীরের ক্লান্তি জুড়ে বসে।
দুপুরে অবশ্যই বিশ্রাম নিন। বিকেলে অতিথি এলে ঘরে আপ্যায়নের জন্য বেশি ব্যাতিব্যস্ত হবেন না। নিজের সামর্থ অনুযায়ী আপ্যায়ন করুন। এর বেশি নয়। এতে চাপ অনেকটাই কমে যাবে।
দিনের মধ্যে এক থেকে দু ঘণ্টা শুধু মাত্র নিজের জন্য রাখুন। সেই সময়টা নিজের ইচ্ছে মতো কাজ করুন। বই পড়ুন, গান শুনুন, লিখুন, ঘুরতে যান বা যা ইচ্ছে করুন। সেই সময় পরিবারের কারও কথা ভাববার দরকার নেই।
সংসারের খরচে আপনারও অধিকার আছে। এ ব্যাপারে নিজেকে দোষী ভাবলে বোকামি করবেন। নিজে রোজগার করলে তো কথাই নেই। সংসারের খরচ থেকেই নিজের জন্য কিছুটা টাকা তুলে রাখুন। পার্লার কিংবা বডি মাসাজের জন্য সেই টাকা খরচ করুন। এটা বিলাসিতা নয়, প্রয়োজন।
নিজের খেয়াল রাখা মানে স্বার্থপরতা নয়। বরং বলা যায়, নিজে ভালো থাকলে অন্যকে ভালো রাখা যায় সহজে। অন্য সদস্যদের যেমন আপনি খেয়াল রাখেন তেমনই নিজের খেয়ালও রাখতে হবে। নিজে ভালো থাকুন, অন্যকে ভালো রাখুন।