fbpx

পিতার নাম ছাড়াই চাকরি, এনআইডিসহ সব সুবিধা পাবেন একাত্তরের যুদ্ধশিশুরা

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে নির্যাতিত বীরাঙ্গনাদের সন্তানদের ‘যুদ্ধশিশু’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেবে সরকার। পিতার নাম ছাড়াই তারা রাষ্ট্রের সব সুযোগ সুবিধা বা অধিকার ভোগ করতে পারবেন। চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রেও পিতার নাম লেখার প্রয়োজন হবে না। এছাড়া দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের যেসব যুদ্ধশিশু রয়েছেন, তারা সবাই যাতে জাতীয় পরিচয়পত্র পান এবং সব ধরনের নাগরিক সুবিধা ভোগ করতে পারেন, সে বিষয়ে সরকারকে সুপারিশ করবে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল-জামুকা।

২৪ অক্টোবর জামুকার ৮২তম বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ–সংক্রান্ত প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানান, যেসব যুদ্ধশিশু জাতীয় পরিচয়পত্র পাননি, তাদের যাতে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি কার্ড) প্রদানসহ অন্য সব ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়, সে জন্য আমরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সংশ্নিষ্টদের কাছে সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

জামুকা সূত্র জানায়, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত পচি বেগমের সন্তান মেরিনা খাতুন জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে গত ৮ সেপ্টেম্বর যুদ্ধশিশু হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চেয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদনটি পাঠান।

আবেদনে মেরিনা খাতুন উল্লেখ করেন, ‘আমার মাতা মৃত পচি বেগমকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রীয়ভাবে ২০১৮ সালের ৪ জুলাই বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। যার গেজেট নম্বর ২০৫। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার মাতা পচি বেগম পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। সে সময় আমি তার গর্ভে জন্মগ্রহণ করি। উল্লেখ্য, সে সময় আমার মাতা বিধবা ছিলেন।

লোকলজ্জার ভয়ে তিনি আমাকে ভ্রূণেই শেষ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যগুণে আমি বেঁচে যাই এবং মায়ের অন্য সন্তানদের দয়া ও ভালোবাসায় আমি বেড়ে উঠি। সম্প্রতি আমার মা পচি বেগম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেও আমার কোনো পরিচয় আজও আমি নিশ্চিত করতে পারিনি।’

১০ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ওই আবেদনটি জামুকার বৈঠকে উত্থাপনের নির্দেশ দেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই–বাছাই ও তালিকা প্রণয়নের কাজটি জামুকার মাধ্যমে হয়।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, একাত্তরের রক্তক্ষয়ী ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে অসংখ্য নির্যাতিত নারীকে উদ্ধার করা হয়। এসকল নারীদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শারীরিক ও মানসিকভাবে পাশবিক অত্যাচার চালায়। যাদের একটা বড় অংশ অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন।

কিন্ত যুদ্ধশেষে বীরাঙ্গনা বা তাদের সন্তানদের অনেক পরিবার গ্রহণ করতে চায়নি। কলঙ্কের বোঝা আর সমাজের অপবাদ সইতে না পেরে অনেক নারী আত্মহত্যা করেন। আবার অনেকে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে স্বাধীনতার পর বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭২ সালে প্রতিটি জনসভায় বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কেউ যদি বীরাঙ্গনাদের পিতার নাম জিজ্ঞেস করে, তবে বলে দিও- তাদের পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। তাদের ঠিকানার পাশে লিখে দিও ধানমন্ডি ৩২ নম্বর।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় লাঞ্ছিত, নির্যাতিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব দেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগেই তখন কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দেশের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসে।

১৯৭২ সালে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ওই বছরের ১৯ জুলাই ১৫ যুদ্ধশিশুর একটি দল প্রথম কানাডার উদ্দেশে বাংলাদেশ ছেড়ে যায়। সেটি তখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ যুদ্ধশিশুদের দত্তক গ্রহণের জন্য এগিয়ে আসে।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা সূত্র থেকে জানা যায়, প্রায় ১০ হাজার যুদ্ধশিশু বর্তমানে প্রবাসে বসবাস করছেন। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ২১ বছর বীরাঙ্গনাসহ যুদ্ধশিশুদের আর কোনো ধরনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ১৯৯৬ ও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েকজন বীরাঙ্গনাকে আর্থিকভাবে সহায়তা দিলেও পরে তাদের আর কোনো খোঁজ নেওয়া হয়নি।

এরপর ২০১৪ সালের ২৭ জানুয়ারি হাইকোর্টের একটি আদেশের পর বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সেবছর ১০ অক্টোবর বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। পরের বছরের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে ওই প্রস্তাব পাস হয়। বর্তমানে দেশে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বীরাঙ্গনার সংখ্যা ৪১৬ জন। যারা মাসিক মুক্তিযোদ্ধার ভাতাসহ মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া সব ধরনের সরকারি সুবিধা পাচ্ছেন।

Advertisement
Share.

Leave A Reply